সূরা ত্বহা

بِسۡمِ اللهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِيۡمِ 
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে


১.) ত্বা-হা।



২.) আমি এ কুরআন তোমার প্রতি এজন্য নাযিল করিনি যে, তুমি বিপদে পড়বে।




৩.) এ তো একটি স্মারক এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে ভয় করে।


 

৪.) যে সত্তা পৃথিবী ও সুউচ্চ আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে এটি নাযিল করা হয়েছে।


৫.) তিনি পরম দয়াবান। (বিশ্ব-জাহানের) শাসন কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন। 


৬.) যা কিছু পৃথিবীতে ও আকাশে আছে, যা কিছু পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানে আছে এবং যা কিছু ভূগর্ভে আছে সবকিছুর মালিক তিনিই।


৭.) তুমি যদি নিজের কথা উচ্চকণ্ঠে বলো, তবে তিনি তো চুপিসারে বলা কথা বরং তার চাইতেও গোপনে বলা কথাও জানেন।


৮.) তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তাঁর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ। 


৯.) আর তোমার কাছে কি মূসার খবর কিছু পৌঁছেছে?


১০.) যখন সে একটি আগুন দেখলো এবং নিজের পরিবারের লোকদেরকে বললো, “একটু দাঁড়াও, আমি একটি আগুন দেখেছি, হয়তো তোমাদের জন্য এক আধটি অংগার আনতে পারবো অথবা এ আগুনের নিকট আমি কোনো পথের দিশা পাবো।”


১১.) সেখানে পৌঁছলে তাকে ডেকে বলা হলো, “হে মূসা! আমিই তোমার রব, জুতো খুলে ফেলো,


১২.) তুমি পবিত্র ‘তুওয়া’ উপত্যকায় আছো। 


১৩.) এবং আমি তোমাকে বাছাই করে নিয়েছি, শোনো যা কিছু অহী করা হয়।


১৪.) আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, কাজেই তুমি আমার ইবাদত করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম করো।


১৫.) কিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তার সময়টা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেকটি প্রাণসত্তা তার প্রচেষ্টা অনুযায়ী প্রতিদান লাভ করতে পারে।


১৬.) কাজেই যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনে না এবং নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে গেছে সে যেন তোমাকে সে সময়ের চিন্তা থেকে নিবৃত্ত না করে। অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।


১৭.) - আর হে মূসা! এ তোমার হাতে এটা কি?”


১৮.) মূসা জবাব দিল, “এ আমার লাঠি। এর ওপর ভর দিয়ে আমি চলি, নিজের ছাগলগুলোর জন্য এর সাহায্যে পাতা পাড়ি এবং এর সাহায্যে আরো অনেক কাজ করি।”


১৯.) বললেন, “একে ছুঁড়ে দাও হে মূসা”!


২০.) সে ছুঁড়ে দিল এবং অকস্মাৎ সেটা হয়ে গেলো একটা সাপ, যা দৌড়াচ্ছিল।


২১.) বললেন, “ধরে ফেলো ওটা এবং ভয় করো না, আমি ওকে আবার ঠিক তেমনটিই করে দেবো যেমনটি সে আগে ছিল।


২২.) আর তোমার হাতটি একটু বগলের মধ্যে রাখো, তা কোন প্রকার ক্লেশ ছাড়াই উজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসবে, এটা দ্বিতীয় নিদর্শন।


২৩.) এজন্য যে, আমি তোমাকে নিজের বৃহৎ নিদর্শনগুলো দেখাবো।


২৪.) এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।”


২৫.) মূসা বললো, “হে আমার রব! আমার বুক প্রশস্ত করে দাও।


২৬.) এবং আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও


২৭.) এবং আমার জিভের জড়তা দূর করে দাও,


২৮.) যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।


২৯.) আর আমার জন্য নিজের পরিবার থেকে সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করে দাও


৩০.) আমার ভাই হারুনকে।


৩১.) তার মাধ্যমে আমার হাত মজবুত করো


৩২.) এবং তাকে আমার কাজে শরীক করে দাও,


৩৩.) যাতে আমরা খুব বেশী করে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারি,


৩৪.) এবং খুব বেশী করে তোমার চর্চা করি।


৩৫.) তুমি সব সময় আমাদের অবস্থার পর্যবেক্ষক।”


৩৬.) বললেন, “হে মূসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো।


৩৭.) আমি আর একবার তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলাম।


৩৮.) সে সময়ের কথা মনে করো যখন আমি তোমার মাকে ইশারা করেছিলাম, এমন ইশারা যা অহীর মাধ্যমে করা হয়,


৩৯.) এই মর্মে যে, এ শিশুকে সিন্দুকের মধ্যে রেখে দাও এবং সিন্দুকটি দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও, দরিয়া তাকে তীরে নিক্ষেপ করবে এবং আমার শত্রু ও এ শিশুর শত্রু একে তুলে নেবে। আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও।


৪০.) স্মরণ করো, যখন তোমার বোন চলছিল, তারপর গিয়ে বললো, “আমি কি তোমাদের তার সন্ধান দেবো, যে এ শিশুকে ভালোভাবে লালন করবে?” এভাবে আমি তোমাকে আবার তোমার মায়ের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি, যাতে তার চোখ শীতল থাকে এবং সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়। এবং (এটাও স্মরণ করো) তুমি একজনকে হত্যা করে ফেলেছিলে, আমি তোমাকে এ ফাঁদ থেকে বের করেছি এবং তোমাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে এসেছি, আর তুমি মাদইয়ানবাসীদের মধ্যে কয়েক বছর অবস্থান করেছিলে। তারপর এখন তুমি ঠিক সময়েই এসে গেছো। হে মূসা!


৪১.) আমি তোমার নিজের জন্য তৈরী করে নিয়েছি।


৪২.) যাও, তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনগুলোসহ এবং দেখো আমার স্মরণে ভুল করো না।


৪৩.) যাও, তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে।


৪৪.) তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে।”


৪৫.) উভয়েই ১৮(ক) বললো, “হে আমাদের রব! আমাদের ভয় হয়, সে আমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে অথবা আমাদের ওপর চড়াও হবে।”


৪৬.) বললেন, “ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, সবকিছু শুনছি ও দেখছি।


৪৭.) যাও তার কাছে এবং বলো, আমরা তোমার রবের প্রেরিত, বনী ইসরাঈলকে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিয়ো না। আমরা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি তোমার রবের নিদর্শন এবং শান্তি তার জন্য যে সঠিক পথ অনুসরণ করে।


৪৮.) আমাদের অহীর সাহায্যে জানানো হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্য যে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।”


৪৯.) ফেরাউন বললো, “আচ্ছা, তাহলে তোমাদের দু’জনের রব কে হে মূসা?”


৫০.) মূসা জবাব দিল, “আমাদের রব তিনি যিনি প্রত্যেক জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন তারপর তাকে পথ নির্দেশ দিয়েছেন।


৫১.) ফেরাউন বললো, “আর পূর্ববর্তী বংশধর যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের তাহলে কি অবস্থা ছিল?”


৫২.) মূসা বললো “সে জ্ঞান আমার রবের কাছে লিপিবদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। আমার রব ভুলও করেন না, বিস্মৃতও হন না।”


৫৩.) তিনিই তোমাদের জন্য যমীনের বিছানা বিছিয়েছেন, তার মধ্যে তোমাদের চলার পথ তৈরী করেছেন এবং উপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর তার মাধ্যমে আমি বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করি।


৫৪.) খাও এবং তোমাদের পশুও চরাও। অবশ্যই এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য বহু নিদর্শনাবলী।


৫৫.) এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরই মধ্যে আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো এবং এ থেকেই আবার তোমাদেরকে বের করবো।


৫৬.) আমি ফেরাউনকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখালাম কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ করতে থাকলো এবং মেনে নিল না।


৫৭.) বলতে লাগলো, “হে মূসা! তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছো যে, নিজের যাদুর জোরে আমাদের দেশ থেকে আমাদের বের করে দেবে?


৫৮.) বেশ, আমরাও তোমার মোকাবিলায় অনুরূপ যাদু আনছি, ঠিক করো কবে এবং কোথায় মোকাবিলা করবে, আমরাও এ চুক্তির অন্যথা করবো না, তুমিও না। খোলা ময়দানে সামনে এসে যাও।”


৫৯.) মূসা বললো, “উৎসবের দিন নির্ধারিত হলো এবং পূর্বাহ্নে লোকদেরকে জড়ো করা হবে।


৬০.) ফেরাউন পেছনে ফিরে নিজের সমস্ত কলাকৌশল একত্র করলো এবং তারপর মোকাবিলায় এসে গেলো।


৬১.) মূসা (যথা সময় প্রতিপক্ষ দলকে সম্বোধন করে) বললো, “দুর্ভাগ্যপীড়িতরা! আল্লাহর প্রতি অপবাদ দিয়ো না, অন্যথায় তিনি কঠিন আযাব দিয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন। যে-ই মিথ্যা রটনা করেছে সে-ই ব্যর্থ হয়েছে।”


৬২.) একথা শুনে তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেলো এবং তারা চুপিচুপি পরামর্শ করতে লাগলো।


৬৩.) শেষ কিছু লোক বললো, “এরা দু’জন তো নিছক যাদুকর, নিজেদের যাদুর জোরে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে উৎখাত করা এবং তোমাদের আদর্শ জীবন যাপন পদ্ধতি ধ্বংস করে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য।


৬৪.) আজ নিজেদের সমস্ত কলাকৌশল একত্র করে নাও এবং একজোট হয়ে ময়দানে এসো। ব্যস, জেনে রাখো, আজকে যে প্রাধান্য লাভ করবে সেই জিতে গেছে।”


৬৫.) যাদুকররা বললো, “হে মূসা! তুমি নিক্ষেপ করবে, নাকি আমরাই আগে নিক্ষেপ করবো?”


৬৬.) মূসা বললো, “না তোমরাই নিক্ষেপ করো।” অকস্মাৎ তাদের যাদুর প্রভাবে তাদের দড়িদড়া ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে বলে মূসার মনে হতে লাগলো


৬৭.) এবং মূসার মনে ভীতির সঞ্চার হলো


৬৮.) আমি বললাম, “ভয় পেয়ো না, তুমিই প্রাধান্য লাভ করবে।


৬৯.) ছুঁড়ে দাও তোমার হাতে যা কিছু আছে, এখনি এদের সব বানোয়াট জিনিসগুলোকে গ্রাস করে ফেলবে, এরা যা কিছু বানিয়ে এনেছে এতো যাদুকরের প্রতারণা এবং যাদুকর যেভাবেই আসুক না কেন কখনো সফল হতে পারে না।”


৭০.) শেষ পর্যন্ত এই হলো যে, সমস্ত যাদুকরকে সিজদাবনত করে দেয়া হলো এবং তারা বলে উঠলোঃ “আমরা মেনে নিলাম হারুন ও মূসার রবকে।”


৭১.) ফেরাউন বললো, “তোমরা ঈমান আনলে, আমি তোমাদের অনুমতি দেবার আগেই? দেখছি, এ তোমাদের গুরু, এ-ই তোমাদের যাদুবিদ্যা শিখিয়েছিল। এখন আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কাটাচ্ছি এবং খেজুর গাছের কাণ্ডে তোমাদের শুলিবিদ্ধ করছি  এরপর তোমরা জানতে পারবে আমাদের দু’জনের মধ্যে কার শাস্তি বেশী কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী।” (অর্থাৎ আমি না মূসা, কে তোমাদের বেশী কঠিন শাস্তি দিতে পারে) ।


৭২.) যাদুকররা জবাব দিল, “সেই সত্তার কসম! যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, উজ্জ্বল সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সামনে এসে যাওয়ার পরও আমরা (সত্যের ওপর) তোমাকে প্রাধান্য দেবো, এটা কখনো হতে পারে না। তুমি যা কিছু করতে চাও করো। তুমি বড়জোর এ দুনিয়ার জীবনের ফায়সালা করতে পারো।


৭৩.) আমরা তো তোমাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে দেন এবং এ যাদু বৃত্তিকেও ক্ষমা করে দেন, যা করতে তুমি আমাদের বাধ্য করেছিলে। আল্লাহই শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই স্থায়িত্ব লাভকারী।”


৭৪.) --প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি অপরাধী হয়ে নিজের রবের সামনে হাযির হবে তার জন্য আছে জাহান্নাম, যার মধ্যে সে না জীবিত থাকবে, না মরবে।


৭৫.) আর যারা তার সামনে মু’মিন হিসেবে সৎকাজ করে হাযির হবে তাদের জন্য রয়েছে সুমহান মর্যাদা,


৭৬.) চির হরিৎ উদ্যান, যার পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এ হচ্ছে পুরস্কার সেই ব্যক্তির যে পবিত্রতা অবলম্বন করে।


৭৭.) আমি মূসার কাছে অহী পাঠালাম যে, এবার রাতারাতি আমার বান্দাদের নিয়ে বের হয়ে পড়ো এবং তাদের জন্য সাগরের বুকে শুকনা সড়ক বানিয়ে নাও। কেউ তোমাদের পিছু নেয় কিনা সে ব্যাপারে একটুও ভয় করো না এবং (সাগরের মাঝখান দিয়ে পার হতে গিয়ে) শংকিত হয়ো না।


৭৮.) পিছন থেকে ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছলো এবং তৎক্ষণাত সমুদ্র তাদের উপর ছেয়ে গেলো যেমন ছেয়ে যাওয়া সমীচীন ছিল।


৭৯.) ফেরাউন তার জাতিকে পথভ্রষ্ট করেছিল, কোন সঠিক পথ দেখায়নি।


৮০.) হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের শত্রুদের হাত থেকে তোমাদের মুক্তি দিয়েছি এবং তূরের ডান পাশে তোমাদের উপস্থিতির জন্য সময় নির্ধারণ করেছি আর তোমাদের প্রতি মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেছি


৮১.) --খাও আমার দেওয়া পবিত্র রিযিক এবং তা খেয়ে সীমালংঘন করো না, অন্যথায় তোমাদের ওপর আমার গযব আপতিত হবে। আর যার ওপর আমার গযব আপতিত হয়েছে তার পতন অবধারিত।


৮২.) তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, তারপর সোজা-সঠিক পথে চলতে থাকে তার জন্য আমি অনেক বেশী ক্ষমাশীল।


৮৩.) আর কোন জিনিসটি তোমাকে তোমার সম্প্রদায়ের আগে নিয়ে এলো হে মূসা”


৮৪.) সে বললো, “তারা তো ব্যস আমার পেছনে এসেই যাচ্ছে। আমি দ্রুত তোমার সামনে এসে গেছি, হে আমার রব! যাতে তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।”


৮৫.) তিনি বললেন, “ভালো কথা, তাহলে শোনো, আমি তোমার পেছনে তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছি এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে।”


৮৬.) ভীষণ ক্রোধ ও মর্মজ্বালা নিয়ে মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এলো। সে বললো, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমাদের রব কি তোমাদের সাথে ভালো ভালো ওয়াদা করেননি? তোমাদের কি দিনগুলো দীর্ঘতর মনে হয়েছে? অথবা তোমরা নিজেদের রবের গযবই নিজেদের ওপর আনতে চাচ্ছিলে, যে কারণে তোমরা আমার সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করলে?


৮৭.) তারা জবাব দিল, “আমারা স্বেচ্ছায় আপনার সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করিনি। ব্যাপার হলো, লোকদের অলংকারের বোঝায় আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং আমরা স্রেফ সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।” -তারপর এভাবে সামেরীও কিছু ছুঁড়ে ফেললো।


৮৮.) এবং তাদের জন্য একটি বাছুরের মূর্তি বানিয়ে নিয়ে এলো, যার মধ্য থেকে গরুর মতো আওয়াজ বের হতো। লোকেরা বলে উঠলো, “এ-ই তোমাদের ইলাহ এবং মূসারও ইলাহ, মূসা একে ভুলে গিয়েছে।”


৮৯.) তারা কি দেখছিল না যে, সে তাদের কথারও জবাব দেয় না এবং তাদের উপকার ও ক্ষতি করার কোন ক্ষমতাও রাখে না?


৯০.) (মূসার আসার) আগেই হারুন তাদের বলেছিল, “হে লোকেরা! এর কারণে তোমরা পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়েছো। তোমাদের রব তো করুণাময়, কাজেই তোমরা আমার অনুসরণ করো এবং আমার কথা মেনে নাও।”


৯১.) কিন্তু তারা তাকে বলে দিল, “মূসার না আসা পর্যন্ত আমরা তো এরই পূজা করতে থাকবো।”


৯২.) মূসা (তার সম্প্রদায়কে ধমকাবার পর হারুনের দিকে ফিরে) বললো, “হে হারুন! তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন আমার পথে চলা থেকে কিসে তোমাকে বিরত রেখেছিল?


৯৩.) তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করেছো?


৯৪.) হারুন জবাব দিল, “হে আমার সহোদর ভাই! আমার দাড়ি ও মাথার চুল ধরে টেনো না। আমার আশঙ্কা ছিল, তুমি এসে বলবে যে, তুমি বনী ইসরাঈলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছো এবং আমার কথা রক্ষা করোনি।”


৯৫.) মূসা বললো, “আর হে সামেরী তোমার কি ব্যাপার?


৯৬.) সে জবাব দিল, “আমি এমন জিনিস দেখেছি যা এরা দেখেনি, কাজেই আমি রসূলের পদাংক থেকে এক মুঠো তুলে নিয়েছি এবং তা নিক্ষেপ করেছি, আমার মন আমাকে এমনি ধারাই কিছু বুঝিয়েছে।


৯৭.) মূসা বললো, “বেশ, তুই দুর হয়ে যা, এখন জীবনভর তুই শুধু একথাই বলতে থাকবি, আমাকে ছুঁয়ো না। আর তোর জন্য জবাবদিহির একটি সময় নির্ধারিত রয়েছে যা কখনোই তোর থেকে দূরে সরে যাবে না। আর দেখ, তোর এই ইলাহর প্রতি, যার পূজায় তুই মত্ত ছিলি, এখন আমরা তাকে জ্বালিয়ে দেবো এবং তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেবো।


৯৮.) হে লোকেরা! এক আল্লাহই তোমাদের ইলাহ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, প্রত্যেক জিনিসের ওপর তাঁর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত।


৯৯.) হে মুহাম্মাদ! এভাবে আমি অতীতে যা ঘটে গেছে তার অবস্থা তোমাকে শুনাই এবং আমি বিশেষ করে নিজের কাছ থেকে তোমাকে একটি ‘যিকির’(উপদেশমালা) দান করেছি।


১০০.) যে ব্যক্তি এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে কিয়ামতের দিন কঠিন গোনাহের বোঝা উঠাবে।


১০১.) আর এ ধরনের লোকেরা চিরকাল এ দুর্ভাগ্য পীড়িত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য (এই অপরাধের দায়ভার) বড়ই কষ্টকর বোঝা হবে।


১০২.) সেদিন যখন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে এবং আমি অপরাধীদেরকে এমনভাবে ঘেরাও করে আনবো যে, তাদের চোখ (আতংকে) দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে।


১০৩.) তারা পরস্পর চুপিচুপি বলাবলি করবে, দুনিয়ায় বড়জোর তোমরা দশটা দিন অতিবাহিত করেছো”


১০৪.) আমি ভালোভাবেই জানি তারা কিসব কথা বলবে, (আমি এও জানি) সে সময় তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী সতর্ক অনুমানকারী হবে সে বলবে, না, তোমাদের দুনিয়ার জীবন তো মাত্র একদিনের জীবন ছিল।


১০৫.) -এ লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, সেদিন এ পাহাড়গুলো কোথায় চলে যাবে? বলো, আমার রব তাদেরকে ধূলি বানিয়ে উড়িয়ে দেবেন


১০৬.) এবং যমীনকে এমন সমতল প্রান্তরে পরিণত করে দেবেন যে,


১০৭.) তার মধ্যে তোমরা কোন উঁচু নিচু ও ভাঁজ দেখতে পাবে না।


১০৮.) --সেদিন সবাই নকীবের আহবানে সোজা চলে আসবে, কেউ সামান্য দর্পিত ভংগীর প্রকাশ ঘটাতে পারবে না এবং করুণাময়ের সামনে সমস্ত আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে, মৃদু খসখস শব্দ ছাড়া তুমি কিছুই শুনবে না।


১০৯.) সেদিন সুপারিশ কার্যকর হবে না, তবে যদি করুণাময় কাউকে অনুমতি দেন এবং তার কথা শুনতে পছন্দ করেন।


১১০.) -তিনি লোকদের সামনের পেছনের সব অবস্থা জানেন এবং অন্যেরা এর পুরো জ্ঞান রাখে না।


১১১.) -লোকদের মাথা চিরঞ্জীব ও চির প্রতিষ্ঠিত সত্তার সামনে ঝুঁকে পড়বে, সে সময় যে জুলুমের গোনাহের ভার বহন করবে সে ব্যর্থ হবে।


১১২.) আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে এবং সেই সাথে সে মুমিনও হবে তার প্রতি কোন জুলুম বা অধিকার হরণের আশঙ্কা নেই।


১১৩.) আর হে মুহাম্মাদ! এভাবে আমি একে আরবী কুরআন বানিয়ে নাযিল করেছি এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী করেছি হয়তো এরা বক্রতা থেকে বাঁচবে বা এদের মধ্যে এর বদৌলতে কিছু সচেতনতার নিদর্শন ফুটে উঠবে।


১১৪.) কাজেই প্রকৃত বাদশাহ আল্লাহ‌ হচ্ছেন উন্নত ও মহান। আর দেখো, কুরআন পড়ার ব্যাপারে দ্রুততা অবলম্বন করো না যতক্ষণ না তোমার প্রতি তার অহী পূর্ণ হয়ে যায় এবং দোয়া করো, হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে আরো জ্ঞান দাও।


১১৫.) আমি এর আগে আদমকে একটি হুকুম দিয়েছিলাম কিন্তু সে ভুলে গিয়েছে এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ় সংকল্প পাইনি।


১১৬.) স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমকে সিজদা করো, তারা সবাই সিজদা করলো কিন্তু একমাত্র ইবলীস অস্বীকার করে বসলো।


১১৭.) এ ঘটনায় আমি আদমকে বললাম,  “দেখো, এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, এমন যেন না হয় যে, এ তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বের করে দেয় এবং তোমরা বিপদে পড়ে যাও।


১১৮.) এখানে তো তুমি এ সুবিধে পাচ্ছো যে, তুমি না অভুক্ত ও উলংগ থাকছো


১১৯.) এবং না পিপাসার্ত ও রৌদ্রক্লান্ত হচ্ছো।”


১২০.) কিন্তু শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল, বলতে থাকলো, “হে আদম! তোমাকে কি এমন গাছের কথা বলে দেবো যা থেকে অনন্ত জীবন ও অক্ষয় রাজ্য লাভ করা যায়?”


১২১.) শেষ পর্যন্ত দু’জন (স্বামী-স্ত্রী) সে গাছের ফল খেয়ে বসলো। ফলে তখনই তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়লো এবং দু’জনাই জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেকে ঢাকতে লাগলো। আদম নিজের রবের নাফরমানী করলো এবং সে সঠিক পথ থেকে সরে গেল।


১২২.) তারপর তার রব তাকে নির্বাচিত করলেন, তার তাওবা কবুল করলেন এবং তাকে পথ নির্দেশনা দান করলেন।


১২৩.) আর বললেন, “তোমরা (উভয় পক্ষ অর্থাৎ মানুষ ও শয়তান) এখান থেকে নেমে যাও, তোমরা পরস্পরের শত্রু থাকবে। এখন যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন নির্দেশনামা পৌঁছে যায় তাহলে যে ব্যক্তি আমার সেই নির্দেশ মেনে চলবে সে বিভ্রান্তও হবে না, দুর্ভাগ্য পীড়িতও হবে না।


১২৪.) আর যে ব্যক্তি আমার “যিকির” (উপদেশমালা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য হবে দুনিয়ায় সংকীর্ণ জীবন এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ করে।”


১২৫.) -সে বলবে, “হে আমার রব! দুনিয়ায় তো আমি চক্ষুষ্মান ছিলাম কিন্তু এখানে আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন?”


১২৬.) আল্লাহ বলবেন, “হ্যাঁ, এভাবেই তো। আমার আয়াত যখন তোমার কাছে এসেছিল, তুমি তাকে ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে।”


১২৭.) -এভাবেই আমি সীমালঙ্ঘনকারী এবং নিজের রবের আয়াত অমান্যকারীকে (দুনিয়ায়) প্রতিফল দিয়ে থাকি এবং আখেরাতের আযাব বেশী কঠিন এবং বেশীক্ষণ স্থায়ী।


১২৮.) তাহলে কি এদের (ইতিহাসের এ শিক্ষা থেকে) কোন পথ নির্দেশ মেলেনি যে, এদের পূর্বে আমি কত জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদের (ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলোতে আজ এরা চলাফেরা করে? আসলে যারা ভারসাম্যপূর্ণ বুদ্ধি-বিবেকের অধিকারী তাদের জন্য রয়েছে এর মধ্যে বহু নিদর্শন।


১২৯.) যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে আগেই একটি সিদ্ধান্ত না করে দেয়া হতো এবং অবকাশের একটি সময়সীমা নির্ধারিত না করা হতো, তাহলে অবশ্যই এরও ফায়সালা চুকিয়ে দেয়া হতো।


১৩০.) কাজেই হে মুহাম্মাদ! এরা যেসব কথা বলে তাতে সবর করো এবং নিজের রবের প্রশংসা ও গুণগান সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সূর্য উদয়ের আগে ও তার অস্ত যাবার আগে, আর রাত্রিকালেও প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং দিনের প্রান্তগুলোতেও। হয়তো এতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।


১৩১.) আর চোখ তুলেও তাকাবে না দুনিয়াবী জীবনের শান-শওকতের দিকে, যা আমি এদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের লোকদেরকে দিয়ে রেখেছি। এসব তো আমি এদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি করার জন্য দিয়েছি এবং তোমার রবের দেয়া হালাল রিযিকই উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী।


১৩২.) নিজের পরিবার পরিজনকে নামায পড়ার হুকুম দাও এবং নিজেও তা নিয়মিত পালন করতে থাকো। আমি তোমার কাছে কোন রিযিক চাই না, রিযিক তো আমিই তোমাকে দিচ্ছি এবং শুভ পরিণাম তাকওয়ার জন্যই।


১৩৩.) তারা বলে, এ ব্যক্তি নিজের রবের পক্ষ থেকে কোন নিশানী (মুজিযা) আনে না কেন? আর এদের কাছে কি আগের সহীফাগুলোর সমস্ত শিক্ষার সুস্পষ্ট বর্ণনা এসে যায়নি?


১৩৪.) যদি আমি তার আসার আগে এদেরকে কোন আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দিতাম তাহলে আবার এরাই বলতো, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের কাছে কোন রসূল পাঠাওনি কেন, যাতে আমরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবার আগেই তোমার আয়াত মেনে চলতাম?


১৩৫.) হে মুহাম্মাদ! এদেরকে বলো, সবাই কাজের পরিণামের প্রতীক্ষায় রয়েছে। কাজেই এখন প্রতীক্ষারত থাকো। শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কারো সোজা-সঠিক পথ অবলম্বনকারী এবং কারা সৎপথ পেয়ে গেছে।

No comments:

Post a Comment